আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা — পিএইচডি — তারপর কী?

ড. রাগীব হাসান
সহযোগী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অফ অ্যালাবামা

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ নিয়ে অনেক লিখেছি। কিন্তু একটা বিষয়ে খুব বেশি আলোচনা দেখি না, তা হলো উচ্চশিক্ষা যেমন পিএইচডি এর পরে কীভাবে ক্যারিয়ার গড়তে হবে। এ নিয়েই আজকের এই লেখা।

স্নাতকোত্তর পর্যায়ে আমেরিকায় দুইটি অপশন — মাস্টার্স, অথবা পিএইচডি। ডিগ্রি শেষ হবার আগে থেকেই চাকুরি খোঁজার কাজটা শুরু করতে হয়, কারণ চাকুরির ইন্টারভিউ থেকে শুরু করে অফার পাওয়া এবং কাজ করার অনুমতি অর্জন পর্যন্ত বেশ অনেকদিন সময় লেগে যায়। তাই যদি কেউ স্প্রিং সেমিস্টারে পড়া শেষ করেন, তাহলে মোটামুটি আগের বছরের ফল সেমিস্টার থেকে চাকুরি খুঁজতে হবে।

পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের জন্য চাকুরির বাজারটা একটু ছোট। মানে কোয়ালিফিকেশন অনুসারে চাকুরি চাইলে সুযোগের সংখ্যাটা কম। আমেরিকার অধিকাংশ কোম্পানিতেই মাস্টার্স লেভেলের ডিগ্রি হলেই চলে, পিএইচডির খুব একটা দরকার নাই। এই কথাটা রিসার্চ ল্যাব আর ইউনিভার্সিটি বাদে মোটামুটি সব কোম্পানির জন্য প্রযোজ্য। পিএইচডি করার পরে কোথায় চাকুরি করবেন সেটা আগে ঠিক করেন। এক সাথে একাধিক দিকে চেষ্টা চালাতে অসুবিধা নাই।

পিএইচডি ধারীরা সাধারণত একাডেমিয়া, রিসার্চ ল্যাব, বা ইন্ডাস্ট্রি — এই তিনটি জায়গায় যথোপযুক্ত চাকুরি পেতে পারেন। দেখা যাক কোথায় কীভাবে নিয়োগ হয় —

১) একাডেমিক চাকুরি — প্রায় সব পিএইচডি শিক্ষার্থীরই স্বপ্নের সোনার হরিণ হলো টেনিউর ট্র্যাক একাডেমিক চাকুরি। পিএইচডি শেষ করার পরে সরাসরি অথবা কয়েক বছর পোস্ট ডক করে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসাবে টেনিউর ট্র্যাকের চাকুরিতে যোগ দেয়া যায়। তার পরে ৬ বছর গবেষণা ও শিক্ষকতায় ভালো কাজ দেখালে এবং রিসার্চ গ্রান্ট / ফান্ডিং বাগাতে পারলে টেনিউর পাওয়া যায় এবং মোটামুটি সারাজীবনের জন্য পাকা চাকুরি পাওয়া যায়। আর একাডেমিক চাকুরির সম্মানও অনেক। বেতনের দিক থেকে কোম্পানির চাকুরির চাইতে কিছুটা কম হলেও নানা সুযোগ সুবিধার বিচারে একাডেমিক চাকুরির তুলনা নাই — আর গবেষণা করাটা পেশার সাথে সাথে যাদের নেশাও বটে, তাদের জন্য প্রফেসর হিসাবে চাকুরি করাটা সবচেয়ে ভালো।

নানা ইউনিভার্সিটিতে টেনিউর ট্র্যাক বা টিচিং/রিসার্চ প্রফেসর হিসাবে চাকুরি পেতে হলে পিএইচডি শেষের বছরখানেক আগে থেকে প্রক্রিয়াটা শুরু করতে হয়। আপনার রিসার্চ ফিল্ডের নানা ম্যাগাজিন/সোসাইটি ইত্যাদির সাইটে চাকুরির বিজ্ঞাপন পাবেন। যেমন কম্পিউটার সাইন্সে কম্পিউটিং রিসার্চ এসোসিয়েশন (CRA) এর সাইটে এসব প্রফেসর চাকুরির বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়। সিভি, রিসার্চ/টিচিং স্টেটমেন্ট, কাভার লেটার এগুলো সহ আবেদন করতে হয়, তার সাথে দিতে হয় ৩-৪টি রেফারেন্স লেটার। সিলেকশন কমিটি এসব আবেদন দেখে প্রথমে ফোন ইন্টারভিউ এবং পরে অন সাইট ইন্টারভিউতে ডাকতে পারে। অন সাইট ইন্টারভিউতে মূলত রিসার্চের উপরে একটি লেকচার, এবং কখনো কখনো ক্লাস লেকচার দিতে হয়। আর সারাদিনের বাকিটা সময় থাকে সার্চ কমিটি বা অন্যান্যদের সাথে ইন্টারভিউ। এমনকি ব্রেকফাস্ট/লাঞ্চ বা ডিনারের সময়েও গল্পের ছলে ইন্টারভিউ চলে। (এই নিয়ে বিস্তারিত আরেক লেখয় লিখবো)। অধিকাংশ জায়গায় ফল থেকে শুরু করা একাডেমিক চাকুরির ইন্টারভিউ জানুয়ার-মার্চ এর মধ্যে হয়ে যায়। এগুলো অবশ্য টেনিউর ট্র্যাকের জন্য — টিচিং বা রিসার্চ প্রফেসর — যা আসলে অস্থায়ী পদ, সেগুলোর জন্য আলাদাভাবে ইন্টারভিউ হতে পারে অন্য সময়েও। আর সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই পরিচিত লোকজনের মাধ্যমে হয়, যেমন কনফারেন্সে কোনো প্রফেসরের সাথে দেখা হবার পরে তাঁকে অনুরোধ করে বা আপনার এডভাইজরের যোগাযোগের মাধ্যমে এগুলো অনেক সময়ে পাওয়া যায়।

তবে কিছু তিক্ত সত্য জানিয়ে রাখি — একাডেমিক টেনিউর ট্র্যাক চাকুরি পাওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার হয়ে গেছে। প্রতিটি পদের বিপরীতে প্রায় ৪০০-৫০০টি আবেদন আসে। এর মধ্যে প্রাথমিক ফোন বাছাইতে সুযোগ পেতে হলে আসলে আপনার এপ্লিকেশনটাকে কারো ঠেলা দেয়া লাগবে — সেটা করার জন্য আপনার পিএইচডি এডভাইজর হলো মোক্ষম ব্যক্তি। আর আপনার পরিচিত থাকলে একটু ঠেলা দিলে প্রাথমিক বাছাইতে সামনে আসতে পারেন। কিন্তু যাই হোক, প্রতি বছর যত পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়, তার মাত্র ১০-১৫% প্রাপক একাডেমিক টেনিউর ট্র্যাকের চাকুরি পান। সেই সংখ্যাও কমছে। আর অনেক ক্ষেত্রেই সদ্য পিএইচডি পাশ করা কারোর বদলে কয়েক বছর পোস্টডক করাদের প্রাধান্য দেয়া হয়। কাজেই চরম ধৈর্য এবং অধ্যবসায় এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞা থাকতে হবে একাডেমিক টেনিউর ট্র্যাক চাকুরি পেতে হলে।

একাডেমিক চাকুরি পেতে হলে কী করতে হবে? প্রথমত — ভালো মানের গবেষণা করতে হবে, নামকরা কনফারেন্স বা জার্নালে পেপার ছাপাতে হবে। সংখ্যার চাইতে মানটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই পিএইচডি করার সময়ে দরকার হলে সময় নিয়ে ভালো কাজ করুন। দ্বিতীয়ত — আপনার এডভাইজরও বাছতে হবে দেখে শুনে। ইউনিভার্সিটির পরিচিতির পাশাপাশি আপনার এডভাইজর কেমন নাম করা সেটা গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয়ত — নেটওয়ার্কিং করতে হবে। এবং চতুর্থত — ইন্টারভিউতে গেলে সেখানে সবাইকে পটাতে হবে ভালো লেকচার দিয়ে আর কথোপকথনে সঠিকভাবে প্রফেশনাল কিন্তু বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে। খুব ভালো রিসার্চ করেছে কিন্তু আচার আচরণে অপেশাদার কিংবা অভদ্র এরকম হলে কাজ হবে না। ইন্টারভিউ এর পুরো সময়টাতেই সবাইকে ভালো করে বিমুগ্ধ করতে হবে সবভাবে।