২০২১ সালে তথ্যপ্রযুক্তি হবে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত

২০২১ সালে তথ্যপ্রযুক্তিরপ্তানি আয়ে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। আগামী দেশের প্রধান রপ্তানি আয়ের পোশাক খাতকে পেছনে ফেলবে ২০২১ সালে তথ্যপ্রযুক্তি খাত। এ লক্ষ্যেই নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।

২০২১ সালে পোশাক খাত থেকে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

পোশাক খাতের রপ্তানি আয়ের এই লক্ষ্যমাত্রার ৪৫ বিলিয়নই চলে যাবে মেশিনারিজ ও কাঁচামাল আমদানি করতে। সে হিসাবে মূল রপ্তানি আয় দাঁড়াবে পাঁচ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ২০২১ সালে তথ্যপ্রযুক্তি সফটঅয়্যার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ বিলিয়ন ডলার। এই পাঁচ বিলিয়ন ডলারের পুরোটাই দেশে থেকে যাবে। এ জন্য কোনো কাঁচামাল আমদানি করতে হবে না। ব্যয় হবে শুধু মেধা। আর ২০২১ সালের আগেই এই পাঁচ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি ছাড়াবে বলে আশা করছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটঅয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি মোস্তাফা জব্বার।

ইপিবিসূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের (জুলাই-ডিসেম্বর) পোশাক খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে এক হাজার ৩৭০ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। এর আগের অর্থবছরে (২০১৫-১৬) হয়েছে দুই হাজার ৮০৯ কোটি ৪১ হাজার ডলার। অন্যদিকে ২০১৫ সালে পোশাক খাতের জন্য মেশিনারিজ ও কাঁচামাল আমদানি করতে হয়েছিল ৬২০ কোটি ১৮ লাখ ডলারের, যা ২০১৬ সালে বেড়ে হয় ৬৯২ কোটি ৫৬ লাখ ৯০ হাজার ডলার। এ খাতের রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ চলে যায় কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানি করতে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পাঁচ বিলিয়ন ডলারের পুরোটাই দেশে থেকে যাবে। তাই ২০২১ সালে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের রপ্তানি আয় পাঁচ বিলিয়ন ডলার ছাড়াতে মাঠে নেমেছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা। এ লক্ষ্যে এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, বিশেষ করে নেপাল, ভুটান, ভারত, শ্রীলংকার একচেটিয়া বাজার ধরতে চান তারা। কারণ এসব দেশ এখনো তথ্যপ্রযুক্তিতে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

মোস্তাফা জব্বার জানান, পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশে যেসব সফটঅয়্যার ব্যবহার করে, সেগুলোর বেশিরভাগই বাংলাদেশে তৈরি হয়। গুণগত মানের দিক থেকে সেসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশ আরও ভালো সফটঅয়্যার তৈরি করে। ফলে এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বাংলাদেশের সফটঅয়্যারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সে সুযোগ কাজে লাগাবে বাংলাদেশ।

এদিকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আরও প্রসার ঘটাতে আগামী ১ থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে মেলার আয়োজন করছে বেসিস। মেলায় দেশি-বিদেশি প্রায় দেড় শতাধিক সফটঅয়্যার প্রতিষ্ঠান অংশ নেবে। মেলা উপলক্ষে ৩০টিরও বেশি সেমিনার ও টেকনিক্যাল সেশন অনুষ্ঠিত হবে।

বেসিসসূত্রে জানা গেছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০১৮ সালের মধ্যে এক বিলিয়ন ডলারের সফটঅয়্যার রপ্তানি হবে।

জানা গেছে, ২০১৫ সালে বিশ্বজুড়ে আউটসোর্সিং বাজারের মূল্য ছিল ৮৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দেশীয় টাকায় প্রায় সাত লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে এ বাজারের তেমন প্রবৃদ্ধি নেই। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের আউটসোর্সিং বাজার বিকাশের জন্য ভিত্তিগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। দেশের আউটসোর্সিং শিল্প ক্রমেই আরও পরিপক্ব হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে অনেক দেশ বাইরে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লাভবান হচ্ছে।

ভৌগোলিকগত দিক থেকে ৯০ শতাংশের বেশি আইটি খাতে ব্যয় হয় উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ ও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে। বর্তমানে বাংলাদেশের আউটসোর্সিং সেবার একটি বড় অংশ যায় ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়ায়। এক্ষেত্রে দেশের উদীয়মান রপ্তানিকারকরা তাদের যোগ্যতার যথেষ্ট প্রমাণ দিয়েছে। বাংলাদেশ সুলভ মানবসম্পদসহ আরও অনেক দিক দিয়েই ভারত ও ফিলিপাইন থেকে এগিয়ে। বাংলাদেশকে আউটসোর্সিংয়ে শীর্ষ উদীয়মান দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ধরা হয়। আউটসোর্সিংয়ের শীর্ষ ৩০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে স্থান দিয়েছে গার্টনার। কারনির সার্ভিস ইন্ডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান আরও চার ধাপ এগিয়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে তিন কোটি ২৯ লাখ এক হাজার ডলারের সফটঅয়্যার রপ্তানি হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তিন কোটি ৫৩ লাখ ছয় হাজার ডলার রপ্তানি হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে চার কোটি ৫৩ লাখ এক হাজার ডলারের সফটঅয়্যার রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ২৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরের সাত কোটি আট লাখ এক হাজার ডলারের রপ্তানি হয়েছে, যা এর আগের বছরের তুলনায় ৫৬ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১০ কোটি ১৬ লাখ তিন হাজার ডলারের রপ্তানি হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় ৪৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রপ্তানি করে ১২ কোটি ৪৭ লাখ দুই হাজার ডলারের। আগের বছরের তুলনায় রপ্তানি বাড়ে ২২ দশমিক ৭১ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রপ্তানি করে ১৩ কোটি ২৫ লাখ চার হাজার ডলারের। এর আগের বছরের তুলনায় রপ্তানি বাড়ে ৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। আর গেল ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রপ্তানি করে ১৫ কোটি ১৮ লাখ ডলারের, যা আগের বছরের তুলনায় ৪ দশমিক ৭১ শতাংশ। এ হিসাবে প্রতিবছরই প্রযুক্তি খাতে রপ্তানি বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এবং আরও বাড়াতে পারলে ২০২১ সালে তথ্যপ্রযুক্তি রপ্তানি আয় পাঁচ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে বলে ধারণা করছেন বেসিস সভাপতি মোস্তাফা জাব্বার।

ইপিবির হিসাবের (১৫ কোটি ১৮ লাখ ডলার) পাশাপাশি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের সূত্রমতে, বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিংয়ে (বিপিও) গত বছর প্রায় ১৩০ মিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। এ ছাড়া ফ্রিল্যান্সার আয়ের সঠিক হিসাব না থাকলেও তাদের আয় ১০০ মিলিয়ন ডলার হবে বলে ধারণা করছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা। বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং, সফটঅয়্যার ডেভেলপমেন্ট, মোবাইল গেইমিং, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন থেকে শুরু করে আইটি সেক্টর, ফ্রিল্যান্সিংÑ সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে বাংলাদেশ প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার আয় করছে।

বেসিস সভাপতি মোস্তাফা জব্বার বলেন, ব্যক্তিপর্যায়ে প্রযুক্তিসেবায় বিপুল পরিমাণ আয় হলেও ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে আসছে না। বর্তমানে বেসিস সদস্যভুক্ত আইটি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯৫৬টি। এদের মধ্য থেকে ৩৮২টি সদস্য প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, গত বছর ৫৯ কোটি ৪৭ লাখ তিন হাজার মার্কিন ডলারের সমমূল্যের সফটঅয়্যার ও আইটি সেবা রপ্তানি করেছে। বেসিস সদস্য ছাড়াও প্রায় এক হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে দেশে। তিনি জানান, ২০১৫ সালে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩৮২টি বেসিস সদস্য প্রতিষ্ঠান থেকে ৫৯ কোটি ৪৭ লাখ তিন হাজার মার্কিন ডলার। ৯৫৬টি সদস্য প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি আয় প্রায় ১৪৮ কোটি ৮৩ লাখ আট হাজার ডলার, বেসিস সদস্য ছাড়া এমন আইটি প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি আয় প্রায় ১৫৫ কোটি ৬৮ লাখ আট হাজার ডলার। সব মিলিয়ে রপ্তানি আয় হচ্ছে প্রায় ৩০৪ কোটি ৫২ লাখ ছয় হাজার মার্কিন ডলারের পণ্য। তবে সব কিছু বাদ দিয়ে মোট ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সফটঅয়্যার রপ্তানি হয়েছে বলে জানান বেসিস সভাপতি।

অবশ্য ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব সঠিক নয় মন্তব্য করেন তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকই বলেছেন অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানি সঠিকভাবে রপ্তানির তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয় না। এ কারণে আসল রপ্তানির চিত্রটি পাওয়া যাচ্ছে না।

তবে ২০২১ সালে তথ্যপ্রযুক্তি রপ্তানি আয় পাঁচ বিলিয়নে পৌঁছাতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ দেখছে বেসিস। এর মধ্যে রয়েছে মানবসম্পদ, অবকাঠামো, বিনিয়োগ, অভ্যন্তরীণ বাজার ও প্রণোদনা। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তিকে আন্তর্জাতিক বাজারে স্থান করে নিতে হলে জনবল তৈরির পাশাপাশি দেশীয় আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঠিক প্রণোদনা দেওয়া এবং তাদের সংরক্ষণে পলিসিগত পরিবর্তন করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা।

বেসিস বলছে, দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন খুবই জরুরি। যে সড়ক দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি প্রবাহিত হবে তার অবস্থা নাজুক। বর্তমানে দেশে ইন্টারনেটের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। দেশে থ্রিজির ইন্টারনেটের গতি নেই বললেই চলে। এ ছাড়া ইন্টারনেটের ক্রয়মূল্যও মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। ফলে একদিকে দেশীয় ব্যবহারকারীর সক্ষমতা বাড়ছে না, অন্যদিকে ক্যাবল ইন্টারনেটের বাইরে রপ্তানি বা আইসিটির কাজ সম্প্রসারণ করা যাচ্ছে না। সরকার ক্যাবল সংযোগ সম্প্রসারণ করতে চেষ্টা করলেও বেতার সংযোগ ও তার গতি খুবই খারাপ। দেশে ইন্টারনেট সংযোগ আরও সূলভ হওয়া উচিত। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে দ্রুতগতির ইন্টারনেট, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং আইটি কোম্পানিগুলোর জন্য সুলভে জায়গা বরাদ্দ দেওয়া দরকার। এ ছাড়া দেশীয় আইটি কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল গঠন করা প্রয়োজন।

বেসিস থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ২০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল বরাদ্দের আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু তা স্থবির হয়ে পড়েছে। মেধাসম্পত্তির মূল্যের সঠিক নির্ধারক না থাকায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে একমাত্র আইডিএলসি ছাড়া আর কেউ আইটি কোম্পানিকে ঋণ দেয় না। বরাদ্দের ৪৩ কোটি টাকা আইটি কোম্পানিগুলোর রপ্তানির সক্ষমতা তৈরিতে পর্যাপ্ত নয়। আইসিটি খাতের বিনিয়োগ গড়ে তোলার জন্য সাধারণ ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ ছাড়াও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সংস্থাগুলোর বিস্তার ঘটাতে হবে বলেও মনে করছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা।

Source:tulpar24.com